নেপথ্যের কারিগর নাদেল
এবারের সিলেট সিটি নির্বাচনের পর অনেকেই তাকে বলছেন ‘নেপথ্যের কারিগর’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে এন্তার আলোচনা। কিন্তু নিজে থেকেছেন চুপ। কথার চেয়ে কাজেই জবাব দিলেন তিনি। এরপর আড়ালেও চলে গেছেন। তিনি সিলেটের
শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হলেও সিলেটের সবকিছুতেই তার হাত রয়েছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে কৌশলেই খাটান প্রভাব। সেই নাদেল এবার সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মুখবন্ধ রেখেই দিলেন অন্য এক জবাব।
তার চালে অসহায় সিলেট আওয়ামী লীগের রাজনীতিকরাও। চমকে দিয়েছেন নগরবাসীকেও।
সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান দু’বছর আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর সিলেটের রাজনীতিতে শূন্যতা দেখা দেয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ভেতরে এ শূন্যতা আরও প্রকট হয়। যোগ্য প্রার্থীর সন্ধান চলে সিলেটে। এরই মধ্যে সিলেট থেকে যারা মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাদের ওপর তেমন ভরসা রাখতে পারছিলেন না কেন্দ্রের নেতারা। এই অবস্থায় ডাক পড়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর। সক্রিয় হয়ে উঠেন নাদেল। কারণ; সিলেট আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি অনেকটা কোণঠাসা। কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার পর সিলেটে তেমন প্রভাব রাখতে পারছিলেন না। মেয়র নির্বাচনে আনোয়ারকে নিয়ে সিলেটের মাঠে নামেন নাদেল। প্রথমে তার অনুসারীদের কাঁধে ভর দিয়ে আনোয়ারের যাত্রা শুরু। তখন অনেকটা বিপরীত মেরুতে হাঁটছিলেন আনোয়ার।
মেয়র পদে দলের ভেতর থেকে একাধিক প্রার্থী হওয়ায় ছিলেন চ্যালেঞ্জের মুখে। কেন্দ্রের গ্রিন সিগন্যাল স্পষ্ট ছিল নাদেলের কাছে। এ কারণে সিলেটে নেমেই মাঠ সাজানো শুরু করেন। বিশেষ করে নানা শ্রেণি- পেশার মানুষের কাছে আনোয়ারকে গ্রহণযোগ্য করতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেনও। সঙ্গে ভালোই তাল মেলান আনোয়ার। ভোটের মাঠে আটঘাট বেঁধে নামেন। এরই মধ্যে এলো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আনোয়ারকে। আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে সিলেট সিটি নির্বাচনে জয়লাভ করলেন আনোয়ার। পেছনের কারিগর হিসেবে কাজ করেন নাদেল।
আওয়ামী লীগও ১০ বছর পর ফিরে পেলো হারানো মসনদ। এতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন নাদেল। তবে- বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভাসেননি। পরিমিত অবস্থায়ই করছেন বিজয় উদ্যাপন। আনোয়ারের বিজয়ের পর নাদেলকে প্রশংসায় ভাসালেন তারই ঘনিষ্ঠজন ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা জুমাদীন আহমদ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন তিনি। বলেছেন; ‘১০ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার। কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যা রাতে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কায়েস্তরাইল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর মতবিনিময় অনুষ্ঠানে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতাংশ উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন ‘উটপাখি’ কবিতার বিখ্যাত চুম্বক অংশ ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে’। না প্রলয় বন্ধ থাকেনি। দীর্ঘ দুই মাসের প্রলয় ছড়িয়েছে এই শহরের ৪২টি ওয়ার্ডে। মানুষের ঘরে ঘরে। ২১শে জুন সেই প্রলয় দৃশ্যমান হয়েছে। মানুষ দলে দলে জনরায় দিয়েছে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে। কিন্তু এই জনরায় ঠেকাতে ঘরের ভেতর অনেক নীতি হয়েছিল। তারা ভুলে গিয়েছিল এই শহরের প্রতিটি ধূলিকণার স্পর্শে বেড়ে ওঠা একজন শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল রয়েছেন।
যিনি সিলেটের এই সময়ে রাজনীতির নিপুণ কারিগর। নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতীয়ভাবে।’ জুমাদীন তার মন্তব্যে নাদেলকে নেপথ্যের কারিগর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সিটি নির্বাচনের পর সিলেটে নাদেলকে নিয়ে অন্য এক আলোচনা। সব নির্বাচনেই তিনি সফল। এবার যেমন নাদেল সিলেট সিটির জয়ের পর ভাসছেন প্রশংসায় তেমনি বিগত দুই টার্ম বিতর্কের ছিটেফোঁটাও লেগেছিল তার গায়ে। কামরানের পরাজয়ের পর ব্যর্থতায় বিতর্কিত হয়েছিলেন তিনি। তখনকার মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাদেল ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনের পর কেন্দ্রের শোকজপ্রাপ্তও হয়েছিলেন। পরাজয়ে তিরস্কৃত হন তিনি। তবে- সিটি নির্বাচনের পর দল পুনর্গঠনে কেন্দ্রে ডাক পড়েছিল তার। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের বদৌলতে আসে এই ডাক। সেই থেকে কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে রাজনীতির মাঠে ভিন্ন এক নাদেলের পদচারণা রয়েছে। এই পদচারণা এখন সিলেট নয়, মৌলভীবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। তার নিজ বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায়। দলে থাকা ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন; নাদেলের পরবর্তী ‘মিশন’ নিজ এলাকায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা। এক্ষেত্রে নাদেল এবার নিজেকে নিজেই নির্বাচনের মাঠে বাজি ধরতে যাচ্ছেন।