বিদায় হজের ভাষণ : সর্বজনীন মানবাধিকারের ইশতেহার
৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে এক লাখ সাহাবা নিয়ে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: হজ সম্পন্ন করেন। এটাই তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ হজ। হজের আরাকান আহাকাম পালন উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ সা: মিনা, মুজদালিফা, আরাফাত ও কাবাঘরে অবস্থানের সময় জনসমক্ষে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের সূচনা করে বলেন, ‘হে জনগণ! এ বছরের পর তোমাদের সাথে এখানে আমার আর কখনো দেখা হয় কি না জানি না। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন! আল্লাহ ওই ব্যক্তির প্রতি দয়া করুন, যে আমার বক্তব্য শুনে স্মরণে রেখেছে এবং এমন ব্যক্তির নিকট তা পৌঁছিয়েছে, যে (তা প্রত্যক্ষভাবে) শোনেনি। অনেক সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান (ফিকহ) বহনকারী ব্যক্তি ওই সব বিষয়ে পারঙ্গম হয় না, অন্য দিকে যার কাছে ওই সব পৌঁছানো হয়; সে তুলনামূলক জ্ঞান-বিজ্ঞান (ফিক্হ) অধিকতর হৃদয়ঙ্গম করতে পারে’। ‘হে জনগণ! নিশ্চয় তোমাদের প্রাণ, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সম্মান মর্যাদাসম্পন্ন তোমাদের এই দিনের মর্যাদার ন্যায়; তোমাদের এই মাসের মর্যাদার ন্যায় এবং তোমাদের এই নগরীর মর্যাদার ন্যায়’। অতঃপর বলেন, হে আল্লাহ! আমি কী পৌঁছিয়েছি? হে আল্লাহ! আমি কী পৌঁছিয়েছি? উপস্থিতরা অনুপস্থিতদের পৌঁছিয়ে দেবে’ (বুখারি, নং ১৬৫২, ১৬৫৪-৫)।
এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি তাঁর ২৩ বছরের রিসালতের মূল বিষয়বস্তু জনগণের কাছে তুলে ধরেন। জাতিসঙ্ঘেরও শত শত বছর আগে ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইট, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (Universal Declaration of Human Rights) চৌদ্দশত বছর আগে মানবতার ঝাণ্ডাবাহী নবী সা: সর্বপ্রথম মানুষের আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষণা করেন। পরস্পর বিরোধী ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে নবী সা:-এর এ ঐতিহাসিক ভাষণ সমগ্র মানবমণ্ডলী ও অখণ্ড মানবতার এক চূড়ান্ত উত্তরণ।
জাহেলি যুগের কুসংস্কার রহিত
‘সাবধান! জাহিলিয়্যাতের সব কিছু আমার দু’পায়ের তলায় রহিত, জাহিলি যুগের রক্তপণ রহিত কিয়ামত পর্যন্ত। প্রথম রক্তপণ যা আমি (পরিত্যাগের) ঘোষণা করছি, আমাদের নিজ গোষ্ঠীর রক্তপণ, ইবন্ রাবি’আ ইবনু হারিছের রক্তপণ, বনূ সা’দ গোত্রে সে (ধাত্রীমাতার) দুধপানরত ছিল, হুযায়লা তাকে হত্যা করে’ (মুসলিম, ২খণ্ড., পৃ.৮৮৬)। ‘পবিত্র কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং হাজীদের পানীয়জল সরবরাহ ছাড়া জাহিলি যুগের অন্য সব সংস্কৃতি বাতিল ঘোষণা করা হলো’।
সুদ প্রথার উচ্ছেদ
‘সাবধান! জাহিলিয়্যাতের সুদ রহিত; প্রথম সুদ যা আমি রহিত ঘোষণা করছি। আমাদের প্রাপ্য ‘আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সুদ তা সম্পূর্ণ রহিত। মূলধনে তোমাদের অধিকার অব্যাহত থাকবে। তোমরা জুলুম করবে না, জুলুমের শিকারও হবে না’ (মুসনাদ দারমী, ২খণ্ড., পৃ.৩২০)।
বর্ণ-গোত্রীয় বৈষম্যের অবসান
রাসূলুল্লাহ সা: শতাব্দীর এমন এক ক্রান্তিকালে এ ভাষণ দেন; যখন গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে বর্ণপ্রথা, বর্ণবৈষম্য, বংশকৌলীন্য ও আভিজাত্যের দম্ভ মানুষকে গৃহপালিত জন্তু অথবা বিশেষ বৃক্ষের চেয়ে হীন পর্যায়ে নিয়ে আসে। রাসূলুল্লাহ সা: মানুষের মনন ও মানসিকতায় এ কথা চিত্রায়িত করতে সক্ষম হন যে, সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান, সম্মানের যোগ্য ও ভালোবাসার পাত্র হলো মানুষ (আবুল হাসান আলী নদভী, নবীয়ে রহমত, ২ খ., পৃ. ২২০)। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘হ জনগণ নিশ্চয় তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতা (আদম আ:) এক। প্রত্যেকে আদমের সন্তান আর আদমের সৃষ্টি মাটি হতে। সাবধান! অনারবের ওপর আরবের কিংবা আরবের উপর অনারবের, কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কিংবা শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। যার মধ্যে আল্লাহ ভীতি আছে, সেই শ্রেষ্ঠ’ অর্থাৎ জাতি বা বর্ণভেদ শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ নয়। একমাত্র আল্লাহ ভীতি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। যে যত বেশি আল্লাহ ভীরু ও পরহেজগার সে তত বেশি শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী (আল-বায়ান ওয়াত্ তিবঈন, ১খ., পৃ.২২৯)।
বর্ণবাদ মানবতার জন্য এক বিরাট অভিশাপ। বর্ণবৈষম্যের ছোবল থেকে মানবতাকে মুক্ত করতে তিনি ঘোষণা করেন, ‘হে জনগণ! আল্লাহকে ভয় কর। কোন কর্তিত নাসা কাফ্রি গোলাম তোমাদের আমির নিযুক্ত হলে, সে যদি তোমাদের আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালিত করে, তবে তার কথা শুনবে এবং আনুগত্য করবে’ (তিরমিজি, ৪খণ্ড.,পৃ. ২০৯)।
কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস হজযরত বেলাল রা:.-কে মদিনার মসজিদের মুয়াজ্জিন নিয়োগ করে তিনি বর্ণবাদের সমাধি রচনা করেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর এ শিক্ষার ভূমিকা কালজয়ী ও বিশ্বজনীন। এর আবেদন আন্তর্জাতিক ও অসাম্প্রদায়িক।
মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন
‘জেনে রেখো! নিশ্চয় মুসলমানরা পরস্পর ভাই, গোটা মুসলিম জগত এক অখণ্ড ভ্রাতৃসমাজ। কোনো মুসলমানের মাল তার সন্তুষ্টি ছাড়া হালাল হয় না। জুলুমের শিকার হয়ো না’। (তাবারী, ২খণ্ড., পৃ.২০৬)। রাসূলুল্লাহ সা:-এর এ ঘোষণা ছিল তৎকালীন সমাজে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ও দ্রোহ। কারণ বংশকৌলীন্য ও রক্তের মর্যাদা ছিল সামাজিক আভিজাত্যের ভিত্তি। তিনি ঈমানদারদের সুভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুদৃঢ় করে এক অখণ্ড দেহসত্তায় পরিণত করেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সব মু’মিন এক মানব দেহের মতো, যদি তার চোখ অসুস্থ হয়; তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর যদি তার মাথা ব্যথা হয় তখন তার সমস্ত দেহ ব্যথিত হয়’ (মিশকাত, ৯ খণ্ড., পৃ. ১২৮)।
দাসপ্রথা উচ্ছেদ
সমাজের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ্ সা: তৎকালীন সমাজে প্রচলিত দাস প্রথা উচ্ছেদে সাহসী ভূমিকা রাখেন। বিশ্ব ইতিহাসে হজরত রাসূলুল্লাহ্ সা.-ই প্রথম যিনি দাসপ্রথার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তখনকার যুগে গোটা গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্য দাসপ্রথার ওপর গড়ে উঠেছিল। খ্রিষ্ট জগত ও আরব সমাজেও ছিল দাসপ্রথার অবাধ প্রচলন। মালিকরা নিজেদের মালিক-মনিব মনে করে দাসদের শ্রম শোষণ করতো, তাদের দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করাতো। দাস মুক্তিতে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে নবী সা: ঘোষণা দেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান দাসকে দাসত্ব হতে মুক্ত করবে, (আজাদকৃত দাসের) প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে আল্লাহ তার (মুক্তি দানকারীর) প্রত্যেক অঙ্গকে দোজখের আগুন হতে মুক্তি দান করবেন’ (মিশকাত, ৩২৩৬ (১)।
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা
জাহিলি যুগে আরব দেশে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। কারণ কন্যাসন্তান জন্মদান করা ছিল তাদের জন্য সামাজিকভাবে অমর্যাদাকর। পিতা তার ঔরসজাত কন্যার নিষ্পাপ মুখ দেখতেও রাজি ছিল না। কেবল আরবে নয়, সারা দুনিয়ায় বিশেষত চীনা, গ্রিসীয়, রোমান ও ভারতীয় সমাজে প্রচণ্ড ধরনের লিঙ্গবৈষম্য ছিল। নারীদের অপবিত্র মনে করা হতো এমনকি মানুষরূপেও গণ্য করা হতো না। সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ও যৌনতৃপ্তি সাধনের অনুষঙ্গী ছিল নারী (সাইয়েদ আফগানী, আল-ইসলাম আল-মারাআত, পৃ. ১৯; মুহাম্মদ রশীদ রেজা হকুক আন-নিসা ফিল ইসলাম, পৃ.৬২)। তিনি নিজে কন্যাসন্তানদের সাথে সমতা ও সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন তাগিদপূর্ণ ভাষায়। যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ে অথবা তিনটি বোন লালন-পালন করবে, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করবে, উপযুক্ত পাত্রে বিয়ে দেবে, রাসূলুল্লাহ্ সা: তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়ে বলেন, সে ও আমি দুই আঙ্গুলের ন্যায় পাশাপাশি জান্নাতে প্রবেশ করব (আবু দাউদ, ৫ খণ্ড, পৃ. ৬১২)। ‘হে জনগণ! তোমাদের নারীদের ওপর তোমাদের হক রয়েছে এবং তোমাদের ওপরেও রয়েছে তাদের হক। নারীদের ওপর তোমাদের হক এই যে, তারা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকেও তোমাদের বিছানাগুলো মাড়াতে দেবে না। তোমাদের ঘরে এমন কাউকেও প্রবেশের অনুমতি দেবে না, যাদের তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা অবাধ্য হয়, তবে তাদের উপদেশ দেবে; বিছানায় তাদের পরিত্যাগ করবে এবং (প্রয়োজনে) তাদের (মৃদু) প্রহার করবে, যখম সৃষ্টিকারী প্রহার নয়। তোমাদের কাছে তাদের অবশ্য-ই কিছু অধিকার রয়েছে। তারা যদি এসব বৈরী কর্মকাণ্ড ছাড়ে এবং আনুগত্য প্রকাশ করে তা হলে সঙ্গত পরিমাণে তাদের খোরপোশ প্রাপ্ত হবে। নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে চলবে; কেননা তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ আল্লাহর আমানত হিসেবে এবং তাদের লজ্জাস্থান তোমরা হালাল করেছ আল্লাহর কালেমার সাহায্যে’ (বুখারি, ২ খণ্ড., পৃ.৩২)।
মানবিক নীতিমালা
নবীজি সা: সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যেসব নীতিমালা প্রণয়ন করেন, বিদায় হজের ভাষণে তিনি ফের তাঁর অনুসারীদের স্মরণ করিয়ে দেন। এগুলোর কঠোর অনুশীলন সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে মৌলিক মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম। বিদায় হজের ভাষণে মানবিক নীতিমালাগুলো জনগণের সামনে পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘কারও কাছে কোনো আমানত জমা থাকলে মালিককে তা ফেরত দিতে হবে’ (আল-বিদায়া, ৫ খণ্ড., পৃ. ২০২ )।
‘হে লোক সকল! আল্লাহ প্রতিটি হকদারের অধিকার আদায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন (অর্থাৎ মিরাসের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন) আর ওয়ারিসের জন্য ওসিয়ত করা বৈধ নয়’ (আবু দাউদ, ২ খণ্ড., পৃ.১২৭, নং ২৮৭০)।
‘সাবধান। অপরাধী নিজ অপরাপধের জন্য দায়ী। সাবধান! পিতার অপরাধে পুত্র দায়ী নয় এবং পুত্রের অপরাপধে পিতাও দায়ী নয়’। ‘ধারে নেয়া বস্তু প্রত্যার্পণযোগ্য; দুধপানের জন্য দানের পশু ফেরতযোগ্য; ঋণ আদায় অপরিহার্য এবং জামিনদার ক্ষতিপূরণের জিম্মাদার’ (তিরমিজি, ৪ খণ্ড., পৃ. ৪৬১, ১৩৫,৪৩৩)।
হজের রীতিনীতি শেখার তাগিদ
‘তোমরা আমার কাছে হতে হজ পালনের রীতিনীতি শিখে নাও, আমি জানি না এ হজের পর আর হজ করতে পারব কি না’ (মুসলিম, ২ খণ্ড., পৃ. ৯৪৩)।
চারটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ
ক. আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরিক করবে না;
খ. আল্লাহ যে প্রাণ বধ করা হারাম করেছেন, তা ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া বধ করবে না;
গ. ব্যভিচার করবে না এবং
ঘ. চুরি করবে না (আল-বিদায়া, ৫ খণ্ড., পৃ. ১৯৭)
ইবাদতের প্রতি গুরুত্বারোপ
‘হে জনগণ। তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করবে; পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে; রামাদান মাসের সিয়ম পালন করবে; সম্পদের জাকাত আদায় করবে এবং তোমাদের শাসকদের আনুগত্য করবে, তবে তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে’ (তিরমিজি, ২ খণ্ড., পৃ.৫১৬, নং ৬১৬।
খাতমে নবুওয়ত
‘হে মানবমণ্ডলী আমার পরে আর কোনো পয়গাম্বরের আবির্ভাব হবে না। তোমাদের পরে আর কোনো উম্মত নেই’ (অতঃপর দুই হাত তুলে বলেন, হে আল্লাহ সাক্ষী থেকো’ (আল-বিদায়া, ৫ খণ্ড., পৃ.২০৩।
ধর্মের ব্যাপারে সতর্কতা
‘সাবধান তোমাদের এ শহরে শয়তানকে কেউ পূজা করবে, শয়তান এ আশা চিরতরে পরিত্যাগ করেছে; কিন্তু যেসব কাজকে তোমরা অতি হালকা বলে মনে করো, এরূপ কাজে তোমরা শয়তানের আনুগত্য করবে এবং এতে সে সন্তুষ্ট হবে। সুতরাং তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে সতর্ক থেকো’ (তাবারি, ২ খণ্ড.,পৃ.২০৫)।
‘তোমাদের পূর্বে আমি হাওযে কাউছারে কাছে পৌঁছাব। অন্যান্য নবীর উম্মতের থেকে আমার উম্মতের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমি গৌরবান্বিত হবো। সুতরাং আমাকে লজ্জায় ফেলো না। আমি অনেকের মুক্তির কারণ হবো (অর্থাৎ আমার সুপারিশের ফলে বহু মানুষ নাজাত লাভ করবে)। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করবো, হে প্রভু! আমার অনুসারীদের রক্ষা করুন। তিনি উত্তরে বলবেন, তুমি জানো না তোমার মৃত্যুর পর তারা দ্বীনের ব্যাপারে কী ধরনের বিদ’আত সৃষ্টি করেছিল’। ‘হে জনগণ! সাবধান! দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে’। (ইবনে মাজাহ ২ খ., পৃ. ১০০৮, নং ৩০২৯)।
কুরআন ও সুন্নাহ : মুক্তির পথ
হে মানবমণ্ডলী! আমার কথা শোন! আমি আমার কথা পৌঁছিয়েছি? আমি তোমাদের কাছে দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি, এগুলো দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে (অনুসরণ করলে) ধরলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না; তা হলো ‘আল্লাহর কিতাব’ ও ‘আমার সুন্নাত’ (জীবনাদর্শ)। (আরেক বর্ণনায় ‘আমার পরিবারবর্গ)। নিঃসন্দেহে ‘সাদাকাত’ আমার নিজের জন্য, আমার পরিবারবর্গের জন্য এবং আমার বংশধরদের জন্য অবৈধ। স্বীয় উষ্ট্রীর কেশর হতে একটি চুল হাতে ধারণপূর্বক তিনি বলেন, দৈর্ঘ্য ও ওজনে এ পরিমাণ ‘সাদাকাত’ও যদি গ্রহণ করা হয়, তা হলে গ্রহীতার ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হবে’ (ইবনে খালদুন, ২ খ., পৃ.৪৭৯)।
নিকটাত্মীয়ের সাথে সদাচরণ
‘তোমাদের মা, তোমাদের পিতা, তোমাদের বোন, তোমাদের ভাই, তোমাদের নিকটাত্মীয় এবং পরবর্তী নিকটাত্মীয়ের সাথে সদাচরণ করবে’।
‘যে সন্তান তার পিতা ব্যতীত অন্য কারো নামে বংশসূত্র দাবি করবে কিংবা দাস-দাসী নিজের মনিব ব্যতীত অন্য কাউকে মনিব সাব্যস্ত করবে, তার উপর কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর লানত এবং সকল ফিরিশতা ও মানুষের অভিশাপ; আল্লাহ তার কোনো নফল কিংবা ফরজ (ইবাদত) কবুল করবেন না’ (আল-বিদায়া, ৫ খ., পৃ. ১৭১)।
ক্ষমা ঘোষণা
‘হে জনগণ! আমার কাছে জিবরাঈল এলেন এবং আল্লাহর পক্ষ হতে সালাম পেশ করে বলেন, আরাফাত ও পবিত্র স্থানে অবস্থানকারীদের ত্রুটি বিচ্যুতি আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন’। উমর ইবন খাত্তাব (রা:) জানতে চাইলেন; এটি কী (কেবল) আমাদের বিশেষত্ব? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করবে (হজ করবে) তাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে’ (আত-তারগীব, ২ খ., পৃ. ২৩১)।
বিদায় হজের সময় আরাফাতের ময়দানে নিম্নোক্ত আয়াত নাজিল হয়
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন মনোনীত করলাম’ (সূরা মায়িদা : ৩)।
‘আমার ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে (বলো তো) তোমরা তখন কী বলবে? উপস্থিত লোকজন বলল, আমরা সাক্ষ্য দেব যে, আপনি অবশ্যই পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আপনি (উম্মতকে) নসিহত করেছেন এবং আপনি দায়িত্ব (যথাযথ আমানত) পালন করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর ‘শাহাদাত’ আঙুল আকাশের দিকে তুলে এবং সমবেত জনতার দিকে নামিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘হে আল্লাহ সাক্ষী থেকো! হে আল্লাহ সাক্ষী থেকো’
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে প্রদত্ত রাসূলুল্লাহ্ সা:-এর বিদায় হজের ভাষণ ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। আধুনিক যুগের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এ ঐতিহাসিক ভাষণের আবেদন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা যদি তাঁর ভাষণের শিক্ষাগুলো অনুসরণ করি তাহলে জুলুমের অবসান হয়ে মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ নিশ্চিত হবে। নিজের অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি সমাজের অপরাপর সদস্যদের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা জরুরি, যাতে কারো প্রতি যেন জুলুম না হয়। মানবতার বিপর্যয়ে বিক্ষুব্ধ বিশ্ব পরিস্থিতিতে দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে নবী সা: প্রদত্ত বিদায় হজের ভাষণের অনুশীলন পৃথিবীকে আবাদযোগ্য, সুন্দর ও প্রীতিময় করে গড়ে তুলতে পারে।
লেখক: সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]